মার্কিন ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো আর কোনো প্রেসিডেন্ট এত বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারেননি। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার সাথে তার সম্পর্কের কথা চাউর হয়ে যায়, যে সম্পর্কটি তৈরি হয়েছিল তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে সহায়তা করার জন্য। কিছু দিন আগেই সে বিষয়ে চূড়ান্ত যে ফয়সালা হয়, তাতে সরাসরি ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। তবে একেবারে নির্দোষ সার্টিফিকেটও দেয়া হয়নি, বরং বিষয়টি কংগ্রেসের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তবে সব মিলিয়ে অভিশংসনের কোপ থেকে সে দফায় বেঁচে যান ট্রাম্প।
ওই ঘটনার কয়েক মাস পার না হতেই নতুন করে বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। যাতে আবারো অভিশংসনের দাবি জোরদার হয়ে উঠেছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জো বাইডেনকে বিপদে ফেলতে ইউক্রেনকে চাপ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। আর এ ক্ষেত্রে নিজের শক্তিমত্তা দেখাতে দেশটিকে দেয়া সামরিক সহায়তা সাময়িকভাবে স্থগিত করেন তিনি, যা কোনোভাবেই আইনসম্মত নয়।
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সহায়তার বিনিময়ে বিশ্বের নানা দেশকে চাপের মুখে রাখা বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে নিজেদের পক্ষে রাখার অভিযোগ বেশ পুরনো। তবে সেসব করা হতো দেশটির বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থে। কিন্তু ট্রাম্প এবার সে পন্থাটিকে ব্যবহার করেছেন একেবারেই দলীয় স্বার্থে। আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একান্ত নিজেরই স্বার্থে। কারণ, ট্রাম্পের সর্বশেষ এ বিতর্কিত পদক্ষেপের ব্যাপারে দলীয় সমর্থন চাইতে গেলে যে তিনি নির্ঘাত কড়া বাধার মুখে পড়তেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই আগামী নির্বাচনে নিজের জয়ের পথ পরিষ্কার করতে গিয়ে নোংরা একটি পথ বেছে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
গত জুলাইয়ের ২৫ তারিখে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কির সাথে ফোনে কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মতোই ধারণা করা হয়েছিল বিষয়টিকে। বিশেষ করে ট্রাম্প যখন বলেছিলেন, চমৎকার আলাপ ছিল সেটা। কিন্তু পরে জানা যায়, সেই আলোচনায় নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকে শিক্ষা দিতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিতে চাপ দিয়েছেন তিনি। ২০২০ সালের অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন রিপাবলিকান দল থেকে। অন্য দিকে হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয়ায় ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত মূল প্রার্থী জো বাইডেন। এ বাইডেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে চাপ দেন ট্রাম্প। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, তারা এতে সম্মত না হলে তাদেরকে দেয়া মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হবে। নিজের হুমকির জোর বুঝাতে এই ফোনালাপের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ওই সামরিক সহায়তা স্থগিত করে দেয়া হয়।
ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ থেকে অভিযোগে বলা হচ্ছে, জো বাইডেন সম্পর্কিত কোনো ক্ষতিকর তথ্য তার বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কির ওপর এমন তদন্তের চাপ দিয়েছেন।
তবে ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে কোনো ধরনের চাপ দেয়ার কথা অস্বীকার করেন। অবশ্য তিনি স্বীকার করেন, জুলাই মাসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কির সাথে ফোনে কথা বলার সময় তিনি জো বাইডেন এবং তার ছেলে হান্টারের ‘দুর্নীতির’ প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।
মূলত ২০১৪ সালে জো বাইডেন যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিন নীতির অন্যতম মুখ্য নির্ধারকের দায়িত্বও পালন করতেন। সে সময় তার ছেলে হান্টার বাইডেন ইউক্রেনের প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি বুরিসমার একজন পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের ছেলে যদি ইউক্রেনের একটি গ্যাস কোম্পানির পরিচালক হন, তাহলে এ ক্ষেত্রে বাইডেন পক্ষপাতহীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কি না, অর্থাৎ এখানে একটা ‘স্বার্থের সঙ্ঘাত’-এর ব্যাপার থেকে যেতে পারে।
২০১৬ সালে বাইডেন ইউক্রেন সরকারের ওপর চাপ দিয়েছিলেন। যার ফলে তারা তাদের শীর্ষ কৌঁসুলি ভিক্টর শোকিনকে বরখাস্ত করে। বাইডেন নিজেই বেশ গর্ব করে এ চাপ দেয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন এক বক্তৃতায়। তিনি বলেছিলেন, আমি ওদের বললাম, আমি এখানে ৬ ঘণ্টা আছি। তোমরা যদি শোকিনকে বরখাস্ত না করো, তাহলে তোমাদের যে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার কথা, তা দেয়া হবে না। তার এ হুমকিতে কাজ হয়েছিল। বরখাস্ত করা হয়েছিল শোকিনকে।
উল্লেখ্য, বুরিসমা কোম্পানির মালিকের দুর্নীতির তদন্ত করছিলেন এ শোকিন। ট্রাম্প ও তার মিত্রদের অভিযোগ, বাইডেন তার ছেলেকে সুরক্ষা দেয়ার জন্যই এ কাজ করেছিলেন।
এখন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে যদি অভিশংসনের উদ্যোগ সামনে এগোয় তাহলে সেটি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে ভোটের জন্য যাবে। সেখানে ডেমোক্র্যাটরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই সেটি সেখানে ভোটে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই পাস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এর পরের ধাপে বিষয়টি সিনেটে যাবে, যেখানে ভোটে দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার। তবে ট্রাম্পের জন্য আশার কথা হচ্ছে, সিনেটে রিপাবলিকানরাই অনেক বেশি প্রভাবশালী। সেখানে আর যাই হোক, ট্রাম্পের প্রতি তাদের যতই ক্ষোভ থাকুক না কেন, অভিশংসনের পক্ষে সায় দিয়ে তারা ডেমোক্র্যাটদের নিশ্চয়ই বিজয়ী করতে যাবেন না। তাই বেশির ভাগ সম্ভাবনা এবারো পার পেয়ে যাচ্ছেন দেশটির ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এ দিকে বিষয়টি মাথায় রেখে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসের কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে সহযোগিতা করা।
ট্রাম্পের এ অভিশংসন ২০২০ সালের প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে পেলোসি বলেন, এটি প্রধান কোনো বিষয় নয়, আমাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে আমেরিকার সংবিধানকে রক্ষা করা। কারণ আমাদের দেশে এমন কোনো প্রেসিডেন্ট থাকা উচিত নয় যিনি তার শপথকে ক্ষুণœ করবেন। এ প্রেসিডেন্ট আমাদের দেশের নিরাপত্তা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে খর্ব করেছেন।
ন্যান্সি পেলোসি দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিশংসনের ব্যাপারে যে তদন্ত চলছে তার প্রতি আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি মানুষ সমর্থন দিচ্ছে।
এমনিতে মার্কিন সংবিধানে অভিশংসনযোগ্য অপরাধ হলো দেশদ্রোহিতা, ঘুষ আদান-প্রদান বা কোনো ধরনের শক্তিশালী অপরাধ। দেশটির ইতিহাসে এ পর্যন্ত তিনজন প্রেসিডেন্ট অভিশংসনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৮৬৮ সালে অ্যান্ড্রু জনসন, ১৯৭৪ সালে রিচার্ড নিক্সন এবং ১৯৯৯ সালে বিল ক্লিনটন। তবে শেষ পর্যন্ত কেউই অভিশংসিত হননি।
তবে বারবার এভাবে অভিশংসনের মুখে পড়া এবং তা থেকে কোনোভাবে পিছলে বেরিয়ে আসার একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশটির সর্বোচ্চ পদে আবারো বসানো উচিত হবে কি না, নিশ্চয়ই বিষয়টি ভেবে দেখবেন দেশটির সাধারণ মানুষ। তারপরও যদি আগামী বছর অনুষ্ঠেয় ওই নির্বাচনে ট্রাম্প পুনর্বার জয়ী হয়েই যান, তাহলে তার স্বেচ্ছাচারিতা আরো অনেক বেশি মাত্রা ছাড়াবে এটা নিশ্চিত। সেই সাথে পুরো বিশ্ব থেকেও বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কায় থাকবে বিশ্বে মোড়লিপনা চালানো এ দেশটি।